একটা বাংলা প্রবাদ আছে, ‘দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্যাদা বুঝে না’। কথাটা অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে। কাজেই একেবারে ভুল বলা যায় না। তবে, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। তারপরও বাজারের বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন প্রকার টুথপেষ্ট নিয়ে অনেকেরই কনফিউশন আছে। সেগুলো থেকে কিছু বিষয় নিয়ে আজকের এই লেখা। টুথপেস্ট নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে পড়তে থাকুন।
দাঁত ব্রাশ করার ক্ষেত্রে টুথপেস্টএর ভূমিকা কি?
টুথপেস্টের মূল দরকারি উপাদান হচ্ছে ফ্লুরাইড (Fluoride)। কিছু ব্যাক্টেরিয়া আছে যেগুলো শর্করাজাতীয় জিনিস যেমন চিনি ভেংগে দেয়ার মাধ্যমে (Glycolysis)এর মাধ্যমে এসিড তৈরি করে। এই এসিড দাঁতের ক্ষয় করে । ফ্লোরাইড এই সমস্যা থেকে সুরক্ষা দেয়। এছাড়া, টুথপেস্টে আরো কিছু সক্রিয় উপাদান থাকে যেগুলো মোটা দাগে নানা উপকার করে। যেমনঃ
-
-
- দাঁতের (অতি)সংবেদনশীলতা বা শিরশির হ্রাস করা,
- দাঁত তুলনামুলক উজ্জ্বল (সাদা) করা,
- Gingivitis বা মাড়ির প্রদাহ (ঘা) প্রতিরোধ করা,
- দাঁতের চারিপাশে পরদ বা টার্টার বিল্ড-আপ হ্রাস করা,
- মুখের দুর্গন্ধ দূর করা ইত্যাদি
-
অনেক টুথপেস্টএর গায়ে লেখা থাকে, ৬ বছরের নীচে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ কি?
ফ্লোরাইড যদিও দাঁতের জন্য জরুরি। এর অতিরিক্ত পরিমাণ আবার দাঁতের জন্য ক্ষতিকর বলেও প্রমানিত হতে পারে। আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড মেডিসিন (National Academies of Sciences, Engineering, and Medicine) ছয় মাসের চেয়ে বেশি বয়সী সমস্ত বাচ্চার জন্য ফ্লোরাইডের একটি পরিমাণ নির্ধারণ করেছে এটা হচ্ছে – 0.05 mg/kg/day (range 0.02 to 0.10 mg/kg/day) । সাধারণত এই মাত্রায় ফ্লোরাইড বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি না করেই দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে সক্ষম হয়।
এর উপর নির্ভর করে আমেরিকান ডেন্টাল এসোসিয়েশন (American Dental Association) এবং আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক ডেন্টিস্ট্রি (American Academy of Pediatric Dentistry) টুথপেস্টের পরিমাণের ক্ষেত্রে সুপারিশ করেছে । তাদের মতে যে প্রথম দাতটি উঠার পর থেকে ৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের টুথপেস্ট এর একটি প্রলেপ ব্যবহার করতে হবে। এর পরিমান হবে একটি মোটা চালের দানার আকারের মত। ৩ বছর থেকে ৬ বছর বয়সি বাচ্চাদের জন্য এটি হবে একটি মটর দানার আকারের পেস্ট। ৬ বছরের কমবয়সী শিশুদের খেয়ে ফেলার ঝুকি থাকে তাই এমন পরিমান নির্ধারন করা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদেরও এর থেকে বেশি টুথপেস্ট ব্যবহার অপ্রয়োজনীয়। বাজারে পাওয়া যায় এমন সব পেস্টেই সাধারণত দরকারী ১০০০ পিপিএম ফ্লোরাইড থাকে।
বাজারের প্রায় সকল টুথপেস্টে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক থাকে। দীর্ঘদিন ব্যবহারে কি কোন সমস্যা হতে পারে?
কারসিনোজেনিক পর্দার্থ ( carcinogenic compound) বলতে বোঝায় যে পদার্থগুলো ক্যান্সার (Cancer) তৈরি করতে পারে। যেমন, সিগারেটের মধ্যে কিছু পদার্থ আছে যা ফুসফুসের ক্যান্সার তৈরি করতে পারে।
আগস্ট ২০১৪ সালে, বিশ্বব্যাপী মিডিয়া কোলগেট টোটাল পেস্টে থাকা ট্রাইক্লোসান ব্যবহারের প্রশ্ন তুলে। তাদের মতে এটা কারসিনজেনিক। পরবর্তিতে ২০১৬ সালে ট্রাইক্লোসান এন্টিব্যাকটেরিয়াল রেজিস্টেন্সের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল। তবে, ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে এই ভয়ে নয়।
১৯৯৭ সালে কোলগেট টোটাল টুথপেস্টে থাকা ট্রাইক্লোসান নিয়ে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছিল ট্রাইক্লোসান Gingivits ( মাড়ির প্রদাহ) প্রতিরোধে কার্যকর। তারপরেও ২০১৯ সালে ট্রাইক্লোসান বাদ দিয়েই পুনরায় কোলগেট টোটাল পেস্ট বাজারজাত হয়। তাই বলা যায় বর্তমানে বাজারে আছে এমন টুথপেস্ট দীর্ঘদিন ব্যবহারেও স্বাস্থ্য ঝুকি নিতান্তই কম।
দাঁত ব্রাশ কিভাবে করা উচিত?
টুথপেস্ট গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বেশি জরুরি ব্রাশ করার পদ্ধতি। দাঁতের সঙ্গে সঙ্গে এটা মুখের স্বাস্থ্যরক্ষায়ও অত্যাবশ্যকীয়। ব্রাশিং পদ্ধতি নিয়মমাফিক হওয়া চাই। অনেকভাবেই ব্রাশ করা যায়। এর মধ্যে Modified Bass technique সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য। ইউটিউবে দেখে এটি রপ্ত করা যায়।
দিনে দুইবার ব্রাশ করা উচিত- রাতে ঘুমানোর আগে এবং দিনে যেকোনো এক সময় ব্রাশ করা উচিত। প্রতিবার ২ মিনিট করে ব্রাশ করা উচিত।
খাবার সাথে সাথে ব্রাশ করা উচিত না অন্তত ৩০ মিনিট বিরতিতে ব্রাশ করা ভালো। এসিডিক খাবার যেমন ফলের জুস কিংবা সফট ড্রিঙ্কস এর বিক্রিয়ার পরে অন্তত ৩০ মিনিট বিরতি দিয়ে ব্রাশ করলে দাঁতের Erosion হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এই সময়ের মাঝে ভালো করে পানি দিয়ে কুলি করা উচিত। নয়তো এসব খাবারের আগেই ব্রাশ করে নেয়া ভালো। খাবার আগে ব্রাশের অসুবিধা একটাই Sodium lauryl sulphate খাবারের স্বাদ নেয়ার প্রোটিনের সাথে বিক্রিয়া করে সাময়িকভাবে স্বাদ পালটে দেয়।
দাঁত ব্রাশ করার পর…
ব্রাশ করার পরে সবচেয়ে কার্যকর সুবিধা পাওয়া যায় লালা ফেলে দিয়ে কুলি না করলে। এতে পেস্টের কার্যকরি উপাদান ধুয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। না পারা গেলে নেহাত অল্প পরিমান (২০মিলি) পানি দিয়ে কুলি করলে। ফ্লুরাইডযুক্ত মাউথওয়াশ (Listacare Whitening Plus) ব্রাশের পরে ব্যবহার করা যাবে। অন্যান্য ফ্লুরাইড বিহীন মাউথওয়াস সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষের জন্য হয় ব্রাশ করার আগে নয়তো অন্য সময়ে ব্যবহার করতে হবে। প্রথমত, মাউথওয়াস পেস্ট ধুয়ে ফেলে দ্বিতীয়ত, টুথপেস্টের Anionic detergent Sodium lauryl suplhate মাউথওয়াশের উপাদান (Cationic Chlorhexidine)-এর সাথে বিক্রিয়া করে লবন তৈরি করে। ফলে, উভয়ের কার্যকরিতা কমে যায়।
দাঁতের মাজন বা অন্যান্য দাঁত মাজার পদ্ধতি সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?
দাঁতের মাজন নিয়ে এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় ‘নিরাপদ না’। কয়লা গুড়া, বিভিন্ন গাছের পাতার গুড়া বা অন্যান্য জিনিস মিশ্রিত করে মাজনগুলো তৈরি করা হয়। ফলে, এগুলোর মান নিয়ে সমস্যা থাকে। এবং সাধারণত ব্যক্তি বা ছোট কোম্পানিকর্তৃক তৈরি হওয়ায় মান নিয়ন্ত্রণে কোন উদ্যোগ থাকে না। মাজন ব্যবহারে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হয়ে যাওয়া, দাঁতের গোড়া বা মাড়ির ইনফেকশন ইত্যাদি হওয়ার সমস্যা হতে পারে।
শিশুর দাঁতের যত্ন নিয়ে জানতে চাইলে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফাহিম আহমাদ (এমবিবিএস, এমডি) এর শিশুর দাঁতঃ সাধারণ জিজ্ঞাস্য ও উত্তর লেখাটি পড়তে পারেন।
এ বিষয়ে আরো কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করুন। নিচের ফর্মটি পুরণ করে ‘পাঠিয়ে দিন’।
ডাঃ শিশির গাজী ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারী (বিডিএস) সমাপ্ত করেছেন।
ডাঃ শিশির গাজী ৩৫তম বিসিএস এর মাধ্যমে সরকারী চাকরিতে যোগদান করেছেন। তিনি সাফল্যের সাথে এফসিপিএস এর প্রথম পর্ব সমাপ্ত করার সাথে সাথে ম্যাক্সিলোফ্যাসিয়াল সার্জারীতে এমডি ডিগ্রী সমাপ্ত করার জন্য অধ্যয়ন করছেন।