আমাদের মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্য

সর্বশেষ সম্পাদনা: ১০ ডিসেম্বর ২০২১, দুপুর ০২:৫৩

যারা জানেন না তাদের জন্য প্রথমেই একটু বলে নেই যে,শনিবার (১০ অক্টোবর) সারাবিশ্বে পালিত হয়েছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য: অধিক বিনিয়োগ-অবাধ প্রবাহ।’  বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস হলো পৃথিবীর সবার মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতার দিন। ১৯৯২ সালে প্রথমবার এ দিবসটি পালন করা হয়। কিছু দেশে একে মানসিক রোগ সচেতনতা সপ্তাহের অংশ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এই প্রবন্ধে আমরা আমাদের মায়েদের (মানে নারীদের) মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করবো।

সাধারণভাবেই আমাদের দেশে মানসিক রোগকে গুরুত্ব কম দেয়া হয়। মানসিক সমস্যা গুরুতর না হলে তার চিকিৎসা করাও জরুরি মনে করা হয় না। আর যখন করা হয় তখনো পানি পড়া, তাবিজ করা ইত্যাদিতেই সাধারণত সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে, কারো যদি মানসিক সমস্যা থাকে এবং সে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় তাহলে তাকে ‘পাগল’ আখ্যা দেয়া হয়। কারণ, মানসিক রোগের ডাক্তার মানেই ‘পাগলের ডাক্তার’। সমস্যাটা নারীদের ক্ষেত্রে আরো প্রকট। অথচ সাধারণ মানসিক সমস্যাগুলো সময়মত ধরতে পারলে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা করতে পারলে রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

মানসিক রোগের জন্য খুব ব্যয়বহুল চিকিৎসা যে লাগে তাও না। আন্তরিকতার সাথে কিছু কথা বলা আর অল্প দামী কিছু ঔষধ দিয়েই বেশিরভাগ সমস্যা দূর করা সম্ভব। দুর্ভাগ্যজনক হলো এটুকুও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। আর, নারীদের সহজাত লুকিয়ে রাখার প্রবণতা ও সামাজিক অবহেলার কারণে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় আমাদের মা-বোন-স্ত্রী-কন্যারা।

Depression is like drowning
মানসিক সমস্যাগুলো পানিতে ডুবার মত। সামান্য একটু সাহায্য একটি জীবন বাচাতে পারে।

কেন আমাদের নারীরা মানসিক সমস্যায় ভুগেন?

মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্য তাদের সামাজিক অবস্থানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এর অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

  • নারী নির্যাতন (শারীরিক ও যৌন)
  • আর্থিক দুর্বলতা
  • নিচু সামাজিক অবস্থান
  • একদম ছোট বয়স থেকে ক্রমাগত দায়িত্বপালন করতে থাকা
  • বিয়ে বা সন্তানধারণের কারণে হঠাত অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাওয়া
  • লজ্জা বা জড়তার কারণে শুরুতে সমস্যার কথা প্রকাশ করতে না পারা ইত্যাদি
Depression
নিজের সমস্যার কথা বলতে হবে

বাংলাদেশে নারীদের মানসিক সমস্যার মাত্রা কেমন?

National Mental Health Survey of Bangladesh, 2018-2019 মোতাবেক বাংলাদেশের প্রায় ১৭% নারী কোন না কোন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এদের মধ্যে প্রায় ৯২% ই কোন চিকিৎসা করান না। এর ফলে মৃদু সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে প্রকাশ পায়। এর আগে ২০০৫ সালে দেখা গিয়েছিল ১৬% প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ কোন না কোন মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। অর্থাৎ মানসিক সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। একই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে ২০২০ সালের শুরুতে করোনার কারণে মানুষ দীর্ঘমেয়াদে ঘরে বন্দী ছিল, আয় করার সুযোগ কমে গেছে, অনেকের চাকরিও চলে গেছে  ইত্যাদি কারণে মানসিক সমস্যা আরো বাড়ার সম্ভাবনা আছে।

ঐ সার্ভে থেকে এটাও জানা গেছে যে, পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা এই সমস্যাগুলোতে বেশি ভুগে।

কোন মানসিক সমস্যাগুলো বেশি দেখা যায়?

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে দেশের মানুষের একটা বড় অংশ মানসিক সমস্যায় ভুগলেও তা সাধারণত খুব জটিল বা তীব্র হয় না ( মেডিকেল পরিভাষায় major psychiatric illness) । বরং এই মৃদু সমস্যাগুলোই ধীরে ধীরে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে। নারীদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম না। উদাহারণ হিসেবে বলা যায়-

১। বিষন্নতা (Depressive Disorders)- ৬.৭%

২। দুশ্চিন্তা (Anxiety Disorder) – ৪.৫%

৩। শুচিবায়ু এবং এ ধরণের অন্যান্য রোগ (Obsessive–compulsive disorder  or OCD)

৪। বড় ধরণের মানসিক রোগ (major psychiatric illness) –  এর মধ্যে আছে বাইপোলার ডিসঅর্ডার (bipolar disorder), সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia)। মাত্র ০.৪% লোক এই ধরণের রোগে ভুগেন। নারীদের ক্ষেত্রে এই রোগের হার আরো কম। 

৫। অন্যান্য রোগ। যেমন- neurodevelopmental disorders, neurocognitive disorders ইত্যাদি

লক্ষনীয় হলো মাত্র ০.৪% লোকের যে সমস্যাটা আছে (অর্থাৎ বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা সিজোফ্রেনিয়া) তাদেরকে মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমরা বাকী ৯৯.৬% রোগের চিকিৎসাই করতে চাই না। এর একমাত্র কারণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। এর পরিবর্তন জরুরি। সবাইকেই বুঝতে হবে টাইফয়েড যেমন একটা রোগ, বিষন্নতাও একটা রোগ। এবং চিকিৎসা করাতে হবে।

প্রিয়জনের মানসিক সমস্যা আছে মনে করলে কোথায় পরামর্শ করবো?

প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য যেকোন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা ইউনিয়ন সাবসেন্টারে গিয়ে একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। যদি গর্ভবতী মহিলা হন এবং নিয়মিত চেকআপে থাকেন তাহলে নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া যায়।

প্রয়োজনে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে মানসিক রোগ বিভাগে দেখা করা যেতে পারে। সেখানে প্রয়োজন মোতাবেক ভর্তি রেখে বা বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা সম্ভব। উচ্চতর চিকিৎসার জন্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, আগারগাও, ঢাকাতে যোগাযোগ করা যায়। 

এছাড়া বিভিন্ন মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকএর চেম্বারেও দেখানো যেতে পারে।

মায়েদের অনেক মানসিক সমস্যার মধ্যে কিছু প্রসবের পর দেখা দেয়। সেগুলো নিয়ে আমাদের নিচের প্রবন্ধটি পড়তে পারেন-

নতুন মায়েদের বিপদজনক রোগঃ প্রসব পরবর্তী মনোব্যাধি (Psychiatric disorders in puerperium)

কিছু জানতে চাইলে প্রশ্ন করুন

 






 

Leave a Comment