নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম কি?
মূলত এটা একটা শিশুদের কিডনির রোগ। এর ফলে শিশুর শরীরে পানি চলে আসে, মুখ ফুলে যায়, প্রস্রাবের পরিমান কমে যায়। এটা বিভিন্ন ধরণের হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় না (idiopathic)। এটাকে ইডিওপ্যাথিক নেফ্রোটিক সিনড্রোম (idiopathic nephrotic syndrome) বলে। এর বাইরেও বেশ কয়েক ধরণের নেফ্রোটিক সিনড্রোম আছে। তবে, এটাই সবচেয়ে কমন। এবং এই প্রবন্ধেও মূলত এটাকেই আলোচনা করবো।
নেফ্রোটিক সিন্ড্রোমের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে:
প্রস্রাবের সাথে প্রোটিন(আমিষ) বের হয়ে যায়(Proteinuria): সাধারণত, প্রস্রাবে অল্প পরিমাণে প্রোটিন নির্গত হয়, কিন্তু নেফ্রোটিক সিন্ড্রোমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, বিশেষ করে অ্যালবুমিন(albumin) নষ্ট হয়ে যায়।
রক্তে অ্যালবুমিন কমে যাওয়া (Hypoalbuminemia): অ্যালবুমিন (albumin)-এর মাত্রা হ্রাস। এটি এমন একটি প্রোটিন যা তরল ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। অ্যালবুমিন বের হয়ে যাওয়ায় রক্তনালীর ভিতরের পানি চামড়ার নিচের ও অন্য কলা (tissue)-এর ভিতর চলে আসে।
শরীর ফুলে যাওয়া/ইডিমা (edema): রক্তনালীর ভিতরে তরল ধরে রাখতে না পারার কারণে সাধারণত পা, গোড়ালি এবং কখনও কখনও মুখ ফুলে যায়।
রক্তে কোলেস্টেরলের উচ্চমাত্রা (Hypercholesterolemia): রক্তে কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডসহ চর্বি (lipid) বেড়ে যায়।
নেফ্রোটিক সিনড্রোম কেন হয়?
কিডনির সবচেয়ে ক্ষুদ্র, কিন্তু আসল কার্যকরী ইউনিট হচ্ছে নেফ্রন(Nephron)। এর ভিতরে থাকে কিডনির রক্তনালী বা গ্লোমেরুলাই (Glomeruli)। এর ভিতর দিয়ে রক্ত আসে এবং ছেকে রক্ত থেকে সাধারণত পানি ও শারীরিক বর্জ্য বের হয়ে যায়। কিন্তু নেফ্রোটিক সিনড্রোমের শিশুদের ক্ষেত্রে পানির সাথে এলবুমিন (albumin) বের হয়ে যায়। ফলে, রক্তে এলবুমিন কমে যায় এবং পানিও রক্ত থেকে বের হয়ে চামড়ার নিচে ও অন্য টিস্যুতে চলে আসে ইডিমা (edema)।
নেফ্রোটিক সিনড্রোমের প্রাথমিক কারণগুলির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন কিডনি রোগ, এবং কিছু সাধারণ হল:
ন্যূনতম পরিবর্তন রোগ(Minimal Change Disease): এটি একটি সাধারণ কারণ, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। সঠিক কারণ প্রায়ই অজানা, এবং কিডনি বায়োপসি একটি মাইক্রোস্কোপের নীচে ন্যূনতম পরিবর্তন দেখাতে পারে। বেশিরভাগ ইডিওপ্যাথিক নেফ্রোটিক সিনড্রোম (idiopathic nephrotic syndrome)-এর কারণ এটাই হয়ে থাকে।
ফোকাল সেগমেন্টাল গ্লোমেরুলোস্ক্লেরোসিস (Focal Segmental Glomerulosclerosis -FSGS): এই অবস্থার মধ্যে কিছু গ্লোমেরুলির ক্ষত (scar) জড়িত, যা কিডনির কার্যকারিতাকে ব্যাহত করে। FSGS অজানা কারণ বা অন্যান্য অবস্থার জন্য হতে পারে।
মেমব্রানাস নেফ্রোপ্যাথি (Membranous Nephropathy): এই অবস্থায়, গ্লোমেরুলার বেসমেন্ট মেমব্রেন ঘন হয়ে যায়, যা পরিস্রাবণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এটি অটোইমিউন রোগ, সংক্রমণ বা ওষুধ সহ বিভিন্ন কারণের কারণে হতে পারে।
এছাড়া ডায়বেটিস, সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস (Systemic Lupus Erythematosus-SLE), অ্যামাইলয়েডোসিস (amyloidosis), সংক্রমণ যেমন- হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি এবং এইচআইভি ইত্যাদি, কিছু ওষুধ যেমন ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs), নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক এবং নির্দিষ্ট ইমিউনোসপ্রেসিভ ওষুধ ইত্যাদি থেকেও নেফ্রোটিক সিনড্রোম হতে পারে।
পরীক্ষা নিরীক্ষা কি করা হয়?
গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাথমিক পরীক্ষার মধ্যে আছেঃ
- CBC
- Urine RE & CS
- Serum albumin
- Serum cholesterol
- 24-hour urinary total protein or
- Urinary protein: creatinine ratio
এছাড়া রোগের কারণ নির্ণয়ের জন্য-
- TPHA
- VDRL
- HBsAG
- Anti HCV IgM & IgG
- HIV
- Blood for C3, C4
- Serum creatinine
এছাড়া অনেক সময় কিডনি বায়োপসি (biopsy)-ও করা প্রয়োজন হয়।
চিকিৎসা কি?
মূল কারণের চিকিৎসা এবং লক্ষণগুলোর চিকিৎসা করা হয়। যদি কোন জটিলতা তৈরি হয় তাহলে সেগুলোরও চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।
খাবারঃ পর্যাপ্ত প্রোটিন (আমিষ) জাতীয় খাবার ও পরিমিত পরিমান পানি খেতে হয়। শরীরে পানি বেশি না হলে স্বাভাবিক মাত্রায় লবণ খাওয়া যায়। তবে, অতিরিক্ত পানি শরীরে থাকলে লবণ কম খেতে হয়।
বিশ্রামঃ সম্ভব হলে স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে পারে। স্কুলেও যেতে হবে।
অন্তর্নিহিত কারণের চিকিৎসা:
নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম সৃষ্টিকারী প্রাথমিক রোগ শনাক্ত করা এবং মোকাবেলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট কিডনি ব্যাধি নির্ধারণের জন্য এটি কিডনি বায়োপসি জড়িত হতে পারে। সাধারণ কারণগুলির মধ্যে রয়েছে ন্যূনতম পরিবর্তনের রোগ, ফোকাল সেগমেন্টাল গ্লোমেরুলোস্ক্লেরোসিস, মেমব্রানাস নেফ্রোপ্যাথি এবং অন্যান্য গ্লোমেরুলার রোগ।
ওষুধ:
- কর্টিকোস্টেরয়েড (corticosteroid): প্রেডনিসলোন(Prednisolone) ও অন্য ওষুধগুলি প্রায়ই প্রদাহ কমাতে এবং ইমিউন সিস্টেমকে (immune system) দমন করার জন্য ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে ন্যূনতম পরিবর্তনের রোগের (Minimal Change Disease) ক্ষেত্রে।
- ইমিউনোসাপ্রেসিভ এজেন্ট (immunosuppressive agents): সাইক্লোস্পোরিন (cyclosporine), ট্যাক্রোলিমাস(tacrolimus), বা মাইকোফেনোলেট মফেটিল (Mycophenolate Mofetil)-এর মতো ওষুধগুলি নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ইমিউন প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন করতে ব্যবহার করা হয়।
- মূত্রবর্ধক(Diuretics): মূত্রবর্ধক ওষুধ, যেমন ফুরোসেমাইড (Frusemide), প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়।
- Angiotensin Converting Enzyeme (ACE) inhibitors এবং angiotensin II receptor blocker (ARBs): এই ওষুধগুলি, যেমন এনালাপ্রিল বা লসার্টান, প্রায়শই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং প্রোটিনুরিয়া কমাতে ব্যবহৃত হয়।
- কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ: রক্তে চর্বির উচ্চ মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্ট্যাটিনগুলি ব্যবহৃত হতে পারে। তবে, সচরাচর এগুলো নেফ্রোটিক সিনড্রোমের রোগীর ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার করা হয় না।
পর্যবেক্ষণ এবং অনুসরণ (Follow Up):
রক্তচাপ, কিডনির কার্যকারিতা এবং প্রস্রাবের প্রোটিনের মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়। এর উপর নির্ভর করে চিকিৎসা পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে, প্রত্যেকটি রোগীই আলাদা। কাজে, চিকিতসার ক্ষেত্রেও পার্থক্য থাকে।
নেফ্রোটিক সিনড্রোম একটি জটিল রোগ। অবহেলার সুযোগ নাই। তবে, সঠিক সময় সঠিক চিকিৎসা নিলে বেশিরভাগ শিশুই ভালো হয়ে যায় এবং পরবর্তীতেও কোন জটিলতা তৈরি হয় না। এজন্য এর চিকিৎসা ভর্তি হয়ে/না হয়ে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের তও্বাবধানে করানোটা জরুরি।
Special Topic: Heat Coagulation Test (ঘরে বসে প্রস্রাব জ্বাল দিয়ে প্রস্রাবে প্রোটিন আছে কিনা দেখবেন?)
ফলোআপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে Heat coagulation test (সাধারণত একে ‘প্রস্রাব জ্বাল দেয়া’ বলা হয়)। ঘরে বসে করা যায়। খরচও সামান্য।
কাদের জন্য করা হয়?
- নেফ্রোটিক সিনড্রোম
- এজিএন (AGN- acute poststreptococcal glomerulonephritis)
- গর্ভাবস্থায় (যদি শরীরে পানি চলে আসে)
- এছাড়া multiple myeloma নামক রোগেও এই পরীক্ষায় পজিটিভ রেজাল্ট আসতে পারে।
পদ্ধতিঃ
একটি টেস্ট টিউবে ৫-১০ মিলি প্রস্রাব নিয়ে তার উপরের অংশে জ্বাল দিতে হয়।
জ্বাল দেয়ার পর উপরের অংশে ২-৩ ফোটা এসেটিক এসিড দিতে হয়। জ্বাল দেয়ার পর যদি ঘোলা ভাব তৈরি হয় এবং এসেটিক এসিড দিলে পরিষ্কার হয়ে যায় তাহলে ধরে নিতে হবে প্রস্রাবে ফসফেট আছে।
এরপর আবার জ্বাল দিতে হবে। প্রোটিন উপস্থিত থাকলে জ্বাল দেয়া অংশ ঘোলা থাকবে। আর না থাকলে প্রস্রাব জ্বাল দেয়ার পরও পরিষ্কার থাকবে।
মাত্রা কিভাবে বুঝবো?
কেমন ঘোলা হচ্ছে সেটা দেখে কি পরিমান প্রোটিন প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যাচ্ছে সেটা ধারণা করা হয়। ধারণা নেয়ার জন্য টেস্ট টিউবের পিছন দিয়ে একটি সাদা কাগজে কিছু লিখে ধরা হয়। যদি স্পষ্ট পড়া যায় তবে ঘোলা থাকে তাহলে (+), যদি পড়তে কষ্ট হয় তাহলে (++), যদি লেখা আছে বোঝা যায় কিন্তু পড়া না যায় তাহলে (+++) এবং যদি লেখা দেখা না যায় তাহলে (++++) ধরা হয়।
সুনির্দিষ্ট মাত্রা বুঝতে হলে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করতে হয়।
ডাঃ ফাহিম আহমাদ ২০০৬ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন। সরকারী বিধি অনুযায়ী দুই বছরের অধিক সময় গ্রামে কাজ করার পর শিশু রোগ সম্পর্কে উচ্চতর পড়াশুনা শুরু করেন। প্রায় ৪ বছর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু রোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এমডি(শিশু) শেষ করার পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে রেজিষ্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-এয় জুনিয়র কনসালটেন্ট (পেডিয়াট্রিক্স) হিসেবে কর্মরত আছেন।