দেশে ৬ মাস পর্যন্ত ‘মাতৃত্বকালীন ছুটি’ (maternity leave) থাকায় শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোটা কিছুটা সহজ হয়। তবে, এই ছুটি বেশিরভাগ কর্মজীবি মা পান না। চাকরির সময় ছাড়াও অনেক সময়ই মাকে দীর্ঘ সময় তার সন্তান থেকে দূরে থাকতে হয়। ফলে, বুকের দুধ খাওয়ানো কঠিন হয়ে যায়। যারা ছুটি পান তাদেরও ৬ মাস পূর্ণ হওার পর ছুটি শেষ হয়ে যায়। অনেক মাকেই ফর্মুলার উপর নির্ভর করতে হয়। বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে জেনেও। এমন পরিস্থিতিতে থাকা মায়েদের জন্য এই প্রবন্ধ।
যারা একটা লম্বা সময় দূরে থাকতে বাধ্য হন এমন মায়েদের জন্য বুকের দুধ সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে খাওয়ানোটা একটা সমাধান হতে পারে।
উদাহারণ হিসেবে, একজন মা হয়তো পরীক্ষায় অংশ নিবে। বাচ্চা ছোট, শুধুমাত্র বুকের দুধ খাচ্ছ। পরীক্ষার জন্য যাতায়াতসহ প্রায় ৫ ঘন্টা মাকে আলাদা থাকতে হবে। তাহলে বাচ্চার খাবারের কি হবে? এমন ক্ষেত্রে কি করা যায়? অনেকেই এই সময়টাতে এসে বাচ্চাকে ফর্মুলা খাওয়ানো শুরু করেন। কিন্তু এটা অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর এবং পরবর্তীতে বুকের দুধ খাওয়ানোয় বাধা সৃষ্টিকারী। বরং পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে মা বাচ্চাকে এক স্তন থেকে দুধ খাওয়াতে পারে এবং অন্য স্তনের দুধ বের করে সংরক্ষণ করতে পারে। ২-৩ ঘন্টা পর বাচ্চা খাওয়ার জন্য কান্না করলে সংরক্ষণ করা দুধ খাইয়ে দেয়া যাবে। এভাবে শিশুর খাওয়ার চাহিদাও পূরণ হয় আবার নবজাতককে ফর্মুলা খাওয়াতেও হয় না।
শিশু যখন মায়ের বুক থেকে দুধ খায় তখন মায়ের স্তনের বোটা থেকে নার্ভ সিগলনাল ব্রেইন পর্যন্ত যায়। ব্রেইনের হাইপোথ্যালামাস থেকে অক্সিটোসিন ও প্র্যোল্যাক্টিন নিঃসরিত হয়।
কিভাবে বুকের দুধ বের করা যায় (How to express breast milk?)
পূর্বপ্রস্তুতিঃ
অক্সিটোসিন রিফ্লেক্সকে উদ্দীপ্ত করা।
১। শান্তিপুর্নভাবে একা অথবা কোন সাহায্যকারীর সাথে বসবেন।
২। দুধ বের করার সময় মা তার শিশুকে কোলের উপর রাখতে পারেন।
৩। মা গরম সেক বা গরম পানি দিয়ে স্তনকে গরম করে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে হালকা গরম পানিতে ভেজানো তোয়ালে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪। মা ধীরে ধীরে নিজের আঙ্গুল দিয়ে বোটা উদ্দীপিত করতে পারেন।
৫। সাহায্যকারী মায়ের পিঠ মালিশ করতে পারে।
বুকের দুধ বের করার জন্য ব্রেস্ট পাম্প ব্যবহার করা যায় অথবা হাত দিয়েও চেপে বের করা যায়।
হাত দিয়ে চেপে বের করার পদ্ধতিঃ
১ম ধাপঃ দুই হাত সাবান ও নিরাপদ পানি দিয়ে ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
২য় ধাপঃ বড় মুখওয়ালা একটি বাটি বা কাপ নিতে হবে। সাবান দিয়ে বাটি/কাপটি ধুয়ে নিতে হবে।
৩য় ধাপঃ বাটি/কাপটিতে ফুটন্ত গরম পানি কয়েক মিনিট রেখে জীবানু ধ্বংস করে নিতে হবে। এবং পানি ফেলে দিতে হবে।
৪র্থ ধাপঃ দুধ রাখার পাত্রটি নিয়ে আরামদায়কভাবে বসতে হবে এবং স্তনের বোটার চারপাশের কালো অংশের (areola) উপরে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং নিচে তর্জনী ও মধ্যমা ‘C’ আকৃতিতে রাখতে হবে। তবে, স্তন চাপ দিয়ে শক্ত করে ধরা যাবে না। (ছবি)
৫ম ধাপঃ স্তনের উপর ‘C’ আকারে ধরা হাত বুকের দিকে আনতে হবে। বড় আকারের স্তনের ক্ষেত্রে, প্রথমে উপরের দিকে তুলতে হবে। এবং এরপর বুকের দিকে আনতে হবে। (ছবি)
৬ষ্ঠ ধাপঃ বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনী দিয়ে স্তনের বোটার চারপাশের কালো অংশের উপর চাপ দিতে হবে এবং ছাড়তে হবে (Press and Release) । (ছবি) এভাবে কিছু সময় করলে দুধ বের হওয়া শুরু হবে। বের হওয়া কমে গেলে একটু ঘুরিয়ে অন্য পজিশন থেকে দুধ বের করতে হবে। এভাবে ক্রমান্বয়ে সবদিক থেকে দুধ বের করে নিতে হবে। (ছবি)
নিচের ভুলগুলো করবেন নাঃ
১। বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনী দ্বারা স্তনের বোটাকে চাপ দিবেন না।
২। স্তনের উপর হাত দিয়ে ঘষাঘষি করবেন না। প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে।
৩। স্তনের বোটা ধরে টানাটানি করবেন না।
সংরক্ষণ করার পদ্ধতিঃ
ঢাকনাসহ কাচের বাটি অথবা বোতলে সংরক্ষণ করা যাবে।
প্রতিটি পাত্রের গায়ে সময় ও তারিখ লেখা থাকবে।
প্রথমে গেলে রাখা দুধ আগে খাওয়াতে হবে।
সময়সীমাঃ
সাধারণ ঘরের ভিতরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় মায়ের দুধ ৬-৮ ঘন্টা পর্যন্ত রাখা যায়।
রেফ্রিজারেটরে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত রাখা যায়।
ডিপফ্রিজে মায়ের বুকের দুধ ৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
ফ্রিজে সংরক্ষিত দুধ খাওয়ানোর নিয়মঃ
গলানোর জন্য জ্বাল দেয়া যাবে না। কুসুম গরম পানি একটা গামলা/বাটিতে নিয়ে তার উপর সংরক্ষিত দুধের পাত্রটি রাখতে হবে।
দুধের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে শিশুকে কাপে অথবা (অবশ্যই সিরামিক/কাচের চামচে) খাওয়াতে হবে। ফিডারে করে খাওয়ানো যাবে না।
উল্লেখ্য, একবার গলানো দুধ আবার সংরক্ষণ করা যাবে না। পুরনো দুধের সাথে নতুন দুধ মিশানো যাবে না।
কিভাবে খাওয়াবেনঃ
- শিশুকে একবারে যতটুকু খাওয়ানো হবে ততটুকু দুধ চামচে (কাচ বা সিরামিক) বা কাচ/সিরামিকের কাপে করে খাওয়াতে হবে।
- চামচ/কাপ হালকা করে শিশুর নীচের ঠোটে ধরতে হবে।
- শিশুটি ঠোটে চামচ/কাপের ছোয়া পেয়ে মুখ হা করবে এবং জিহবা দিয়ে মুখে নিতে থাকবে এবং অল্প অল্প করে চুষে খেয়ে ফেলবে। (ছবি)
কেন ফিডারে না দিয়ে কাপে খাওয়ানো শিশুর জন্য উপকারীঃ
- বুকের দুধ খাওয়ার অভ্যাস নষ্ট হয় না। অনেক সময় শিশু ফিডার ও বুকের দুধ একই সাথে পেলে দুই ধরণের অভিজ্ঞতার কারণে অস্বস্তির শিকার হয় (nipple confusion)। অনেক ক্ষেত্রে বুকের দুধ খেতে আগ্রহ কমে যায়।
- বোতলের চাইতে সংক্রমণের আশংকা কম। ফলে ডায়রিয়া, কানের সংক্রমণ ইত্যাদি কম হয়।
- কাপ পরিষ্কার করা সহজ। সিদ্ধ না করা গেলেও সাবান পানির দ্বারা দ্রুত জীবানুমুক্ত করা সম্ভব।
কতবার বুকের দুধ বের করে সংরক্ষণ করা সম্ভব?
এটি আসলে নির্ভর করে কারণের উপর। যেমন-
- অসুস্থ শিশু বা কম জন্ম ওজন বিশিষ্ট শিশুর ক্ষেত্রে- শিশু যতবার দুধ খেতে চাইবে ততবারই। মায়ের দুধ সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখতে অন্ততঃ ৩ ঘন্টা পর পর বা দিনে-রাতে ২৪ ঘন্টায় ৮ বার।
- মা অসুস্থ থাকলেঃ শিশু যতবার খেতে চাইবে ততবারই।
- কর্মজীবি মায়ের ক্ষেত্রেঃ মা কাজে যাওয়ার আগে যতটুকু সম্ভব দুধ চেপে বের করে রেখে যাবেন।
শিশুকে কতটুকু খাওয়াতে হবে?
ক্ষুধার্ত শিশু প্রথমবার অল্প খেলে পরেরবার বেশি খেতে দিন। অথবা, অল্প সময়ের ব্যবধানে আবার খেতে দিন।
মায়ের স্তনে যদি অল্প দুধ থাকে, তবে সবটুকু খেতে দিন।
স্বল্প ওজনের শিশুদের প্রথম কয়েকদিন খুব অল্প দুধ প্রয়োজন হয়।
মা যতটুকু শালদুধ তৈরি করে সেটুকুই বেশিরভাগ শিশুর জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে।
বুকের দুধ শিশুর সর্বশ্রেষ্ঠ খাবার। প্রত্যেক মা-এরই চেষ্টা থাকে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে। কর্মজীবী মায়েদের জন্য কাজটি আরো কঠিন হয়ে থাকে। তবে, সব দিক থেকে সহযোগিতা পেলে কাজটি সহজ হয়ে যায়। অনেক সময় সঠিক তথ্য না জানাটাও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আশা করি বুকের দুধ বের করে খাওয়ানোর ক্ষেত্রে এই প্রবন্ধটি মায়েদের সহযোগিতা করবে।
কোন কোন মায়েদের বুকের দুধ কমে যায়। তারা মায়ের বুকের দুধ কম হওয়ার কারণ ও বৃদ্ধির উপায় এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
যেকোন প্রশ্ন থাকলে নিচের ফর্মটি ব্যবহার করুনঃ
ডাঃ ফাহিম আহমাদ ২০০৬ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন। সরকারী বিধি অনুযায়ী দুই বছরের অধিক সময় গ্রামে কাজ করার পর শিশু রোগ সম্পর্কে উচ্চতর পড়াশুনা শুরু করেন। প্রায় ৪ বছর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু রোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এমডি(শিশু) শেষ করার পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে রেজিষ্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-এয় জুনিয়র কনসালটেন্ট (পেডিয়াট্রিক্স) হিসেবে কর্মরত আছেন।