শিশুর খাবার নিয়ে প্রত্যেক অভিভাবকেরই দুশ্চিন্তা থাকে। শিশুর খাবার কেমন হবে সেটা বুঝতে খাবারের মধ্যে কি কি উপাদান থাকে এবং কি কাজে লাগে সেটা বুঝে নিলে ভালো হবে। প্রথম আমি সেটা নিয়েই আলোচনা করবো।
আপনার এই মুহুর্তেই এত সময় নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে, আপাতত শুধু প্রয়োজনীয় অংশটুকু পড়ে নিতে পারেন-
- শিশুর বয়স অনুযায়ী খাবার কেমন হওয়া উচিত সেটা জানতে চান তাহলে এখানে ক্লিক করুন।
কিভাবে আপনার শিশুর বাড়তি খাবার শুরু করবেন সেটা জানতে এখানে ক্লিক করুন। - বাচ্চার ওজন বেড়ে যাচ্ছে? কি করবেন জানতে এখানে ক্লিক করুন।
বাচ্চার ওজন কম? কি করবেন জানতে এখানে ক্লিক করুন। - আপনি যদি নবজাতকের খাবার ও যত্ন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন তাহলে এখানে ক্লিক করুন।
খাবারের উপাদানঃ
১। কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা (carbohydrate)- এগুলো খাবারের মূল উপাদান। যেমন- ভাত, আলু, চিনি, রুটি, সাগু, বার্লি ইত্যাদি। এগুলো শারীরিক কার্যক্রমের শক্তির মূল উৎস।
২। প্রোর্টিন বা আমিষ (Protein)- এগুলো শরীর গঠনের উপাদান। এগুলো থেকেই মাংস, হাড় ইত্যাদি তৈরি হয়। শরীর
৩। ফ্যাট বা চর্বি (Fat)
৪। ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ (Vitamin)
৫। খনিজ উপাদান (Minerals)
৬। পানি (Water)
অনেকেই খাবারের তন্তু (dietary fibre) বা, ডায়েটারি ফাইবারকে খাবারের ৭ম উপাদান হিসেবে গণ্য করেন। খাবারের উপাদান বলি আর নাই বলি খাবারে তন্তু বা ফাইবার থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডায়েটারি ফাইবার মল বা পায়খানায় পানি ধরে রাখে। সুতরাং যদি খাবারে তন্তু কম থাকে তাহলে মলে পানি কম থাকবে এবং মল শক্ত হয়ে যাবে। অন্যদিকে যদি খাবারে ডায়েটারি ফাইবার বা তন্তু যথেষ্ট পরিমানে থাকে তাহলে পানি বেশি ধরে রাখে ফলে মল নরম হয়।
সুষম খাবারঃ
সাধারণভাবে বললে সুষম খাবার বলতে এমন খাবারকে বোঝায় যেখানে সব ধরণের খাদ্য উপাদান যথাযথ পরিমানে থাকে।
সুষম খাবার আসলে কোন একটি খাবার না। বরং সারাদিনে সঠিকভাবে খাওয়া বিভিন্নরকম খাবারের সমষ্টি। সুতরাং সকালের নাস্তায় যদি কিছু ভিটামিন অনুপস্থিত থাকে সেটা আবার দুপুরের খাবার দিয়ে পুরণ হয়ে যায়। আবার, রাতের খাবারে এসে হয়ত কিছু মিনারেল বা খনিজ উপাদান থাকে। সারাদিনই আমরা পানি, বা ফলমূল খাই। সবগুলো মিলিয়েই সুষম খাবার।
কাজেই বোঝাই যাচ্ছে যে একই রকম খাবার বার বার খেতে থাকলে কোন ভিটামিন বা মিনারেল বা অন্য কোন খাদ্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ফলশ্রুতিতে বাচ্চার অপুষ্টি দেখা দিতে পারে।
শিশুর খাবার কেমন হওয়া চাই?
উপরের আলোচনা থেকেই স্পষ্ট যে খাবার সুষম হতে হবে। সহজে বোঝানোর জন্য বলা যায় পাচ ধরণের খাবার আমাদের খেতে হবে।
খাবারের অর্ধেক থাকবে শাকসবজি ও ফলমূল এবং অন্য অর্ধেক থাকবে শর্করা জাতীয় খাবারগুলো (ভাত, রুটি, আলু, চিনি ইত্যাদি) ও আমিষ জাতীয় খাবার (মাছ, মাংস, ডাল, ডিম ইত্যাদি)। প্রথম অর্ধেকের মধ্যে শাকসবজির পরিমান ফলের চেয়ে একটু বেশি হবে। এবং দ্বিতীয় অর্ধেকের মধ্যে আমিষ জাতীয় খাবার সামান্য কম থাকবে এবং শর্করা জাতীয় খাবার একটু বেশি থাকবে। এগুলোর সাথে থাকবে পরিমিত পরিমানে দুধ বা দুধ জাতীয় খাবার।
উল্লেখ্য, দুই বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য গরুর দুধ, ছাগলের দুধ ইত্যাদি নিষেধ। তবে, ৬ মাসের পর থেকেই দই খেতে পারবে।
বয়সভিত্তিক খাবারঃ
খাবারের মধ্যে বাচ্চার বয়সের উপর নির্ভর করে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। ১ মাসের বাচ্চার যে খাবার সেটা তো আর ২ বছরের বাচ্চাকে দিলে হবে না।
৬ মাসের (৬-৮ মাস) শিশুর খাবার তালিকা কেমন হবে?
বাবুর বয়স ৬ মাস হয়ে গেলে তাকে বুকের দুধএর পাশাপাশি বাড়তি খাবার দেয়া শুরু করতে হবে। এই সময়ে শিশুর খাবার হবে বুকের দুধ (breast feeding) এবং বাড়তি খাবার (complementary food)। ৬-৮ মাসের সময়টাতে বুকের দুধের পাশাপাশি ২৫০মিলি ধারণ ক্ষমতার বোল (bowl) এর অর্ধেক করে ২ বার খাবার দিতে হবে। এছাড়া, ১-২ বার হালকা নাস্তা জাতীয় খাবার দেয়া যেতে পারে।উদ্দেশ্য থাকবে বাবু যেন ২০০ কি.ক্যা. পরিমাণ এনার্জি এই বাড়তি খাবার পেয়ে যায়।
৯ মাসের (৯-১১ মাস) শিশুর খাবার তালিকা কেমন হবে?
বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার চলবে। এই সময়টাতে বুকের দুধের পাশাপাশি ২৫০মিলি ধারণ ক্ষমতার বোল (bowl) এর অর্ধেক করে ৩ বার খাবার দিতে হবে। এছাড়া, ১-২ বার হালকা নাস্তা জাতীয় খাবার দেয়া যেতে পারে। উদ্দেশ্য থাকবে বাবু যেন ৩০০ কি.ক্যা. পরিমাণ এনার্জি এই বাড়তি খাবার পেয়ে যায়।
১২-২৪ মাসের শিশুর খাবার তালিকা কেমন হবে?
বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার চলবে। এই সময়টাতে বুকের দুধের পাশাপাশি ২৫০মিলি ধারণ ক্ষমতার বোল (bowl) এর পুরোটা করে ৩ বার খাবার দিতে হবে। এছাড়া, ১-২ বার হালকা নাস্তা জাতীয় খাবার দেয়া যেতে পারে। উদ্দেশ্য থাকবে বাবু যেন ৫৫০কি.ক্যা. পরিমাণ এনার্জি এই বাড়তি খাবার পেয়ে যায়।
শিশুর বাড়তি খাবার কিভাবে শুরু করবেন?
০৬ (ছয়) মাস বা ১৮০ দিন পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর বাড়তি খাবার শুরু করবেন। একেকটি খাবার একেক বারে শুরু করবেন। একটি খাবার শুরুর ৭-১০ দিন পর আরো একটি খাবার শুরু করবেন। এক বছর বয়স হওয়ার আগে ধীরে ধীরে তাকে ঘরে রান্না হয় এমন সবগুলো খাবারে অভ্যস্ত করে তুলবেন।
উদাহারণ হিসেবে, বাবুর বয়স ১৮০দিন হওয়ার পর তাকে কলা দিতে পারেন। সে শুধু বুকের দুধ ও কলা খাবে। সারাদিনে কয়েকবার অল্প অল্প করে কলা দেয়া যাবে। এক সপ্তাহ পর তাকে ডিম দেয়া শুরু করবেন। পরবর্তী এক সপ্তাহ বাবু বুকের দুধের পাশাপাশি কলা ও ডিম খাবে। আরো এক সপ্তাহ পর তার খাবারে নুডলস যোগ করা যায়। এর ফলে পরের এক সপ্তাহ সে বুকের দুধের পাশাপাশি কলা, ডিম ও নুডলস খাবে। এভাবে একের পর এক তাকে ঘরের সবগুলো খাবার দিবেন।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খেয়াল রাখবেনঃ
১। খাবার ব্লেন্ড করবেন না
বরং প্রয়োজন বোধে হাতে কচলিয়ে দিবেন। ব্লেন্ড করা খাবার একদম নরম হয়। এর ফলে বাচ্চাকে ঐ খাবার খাওয়ার জন্য চিবুতে হয় না। ফলে, মাড়ি, দাঁত, চোয়াল, ও মাংসপেশির উপর চাপ পড়ে না। এগুলো দুর্বল থাকে। দাঁতের উপরের স্তর বা এনামেল পাতলা হওয়ায় দাঁত সহজেই ক্ষয় হয়ে যায় (ডেন্টাল ক্যারিজ হয়)।
২। খাওয়ানোর সময়
বাবুকে দীর্ঘ সময় ধরে খাওয়াবেন না এবং খাওয়ার জন্য জোড় করবেন না। এতে দীর্ঘমেয়াদে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এক. বাবু খাওয়াটাকে খেলা হিসেবে নেয়। ফলে, খাওয়াটার পিছনে সময় বেশি গেলেও খাওয়া কম হয়। দুই. খিদে লাগলে খেতে হয় এবং খিদে চলে গেলে খাওয়া বন্ধ করে দিতে হয় এই বিষয়টা বাবু শিখে না। ফলে, পরবর্তী জীবনেও খাওয়ায় অনিয়ম করায় অভ্যস্ত হয়। তিন. খাবার বাছাবাছি করার প্রবণতা তৈরি হয়।
৩। শিশুর খাবার রুটিন
রুটিন খুবই গুরুত্বপুর্ণ। নির্দিষ্ট একটা সময়ে খাওয়ার (এবং খাওয়ানোর) চেষ্টা করবেন। এতে বাবুর মধ্যে ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হবে। এটা সারাজীবনই তার জন্য উপকারী হবে। সাধারণ নিয়ম হলো ৩টা মূল খাবার
৪। একত্রে বসে খাওয়া
পরিবারের সবাই একসাথে বসে খাওয়ার চেষ্টা করবেন। সবাই বসে বাবুর জন্যও একটা প্লেটে আলাদা করে খাবার দিবেন। বাচ্চারা অনুকরণ করা পছন্দ করে। ফলে, সে মা-বাবাকে খেতে দেখে নিজেও খেতে আগ্রহী হবে। সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে শেষ খাবারটুকু হয়তো তুলে খাইয়ে দিবেন। যত তাড়াতাড়ি বাবু নিজে খেতে শিখবে তত ভালো।
৫। খাবারে বৈচিত্র
খাবারে বৈচিত্র থাকা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। বাবুকে বিভিন্ন ধরণের খাবার খেতে অভ্যস্ত করে তুলুন। একই খাবারে অভ্যস্ত না করে যত বেশি প্রকার খাবার সম্ভব তাকে খেতে দিন। এতে বাবুটা সব রকমের পুষ্টি উপাদান পেয়ে যাবে।
বিশেষ বিবেচনাঃ
বাচ্চার ওজন বেড়ে যাচ্ছে। কি করবেন?
ওজন বেড়ে যাওয়ার অনেক রকম কারণ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় – বেশি খাওয়া ও কম পরিশ্রম। এরকম ক্ষেত্রে বাচ্চার খাবার থেকে তেল ও চিনি থাকা খাবার কমিয়ে দিতে হবে। যেমন – চকলেট/লজেন্স, বিভিন্ন প্রকার সফট ড্রিংক্স, ফলের রস, দোকানে থাকে জুস, পিজ্জা/বার্গার/চিকেন ফ্রাই ইত্যাদি ফাস্ট ফুড ইত্যাদি কমিয়ে দেয়া যায়। একই সাথে বাচ্চাকে শারীরিক পরিশ্রম হয় এমন কাজে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করবেন। বাসার আসেপাশে সুযোগ থাকলে বাগান করা, বা খেলাধুলা করা ইত্যাদিতে আগ্রহী করার চেষ্টা করুন। একটু বড় হলে পুরো বিষয়টা তাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে করানোর চেষ্টা করুন। জোড় করে খাওয়া বন্ধ করে দিবেন না। বরং তার সাথে এক ধরণের চুক্তি করুন। তবে, পুরো বিষয়টাতে ধৈর্য্য ধরে এবং নমনীয় থেকে লেগে থাকতে হবে।
ব্যবস্থাগুলো নেয়ার পরও যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এছাড়া, যদি অল্প সময় ওজন বেড়ে যায় বা ওজন বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্য সমস্যা থাকে তাহলে দ্রুত একজন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
বাচ্চার ওজন কম। কি করবেন?
যদি আসলেই বাবুর ওজন কম থাকে তাহলে আমরা তার খাবারে কিছু পরিবর্তন আনতে পারি। খাবারের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারি। এ উদ্দেশ্য সফলের জন্য খাবারে বৈচিত্র আনতে পারি। সবাই একসাথে বসে খেতে পারি। বাচ্চাও দেখে দেখে খাবে। খাবারের বৈচিত্র বাড়ানোর আরেকটা সুবিধা হলো বাবুর কোন নির্দিষ্ট ভিটামিনের অভাবে অরুচি হলে সেই ভিটামিনএর চাহিদা পুরন হয়ে যাবে এবং বাবুর রুচি বেড়ে যাবে।
এছাড়া, আমরা খাবারে চিনি ও তেলএর পরিমাণ বাড়াতে পারি। অর্থাৎ কিছুদিনের জন্য খাবারে চিনি ও তেলের ব্যবহার বাড়াতে পারি। যেমন, ডিম সেদ্ধ না খাইয়ে বাবুকে ডিম পোচ বা মামলেট করে খাওয়াতে পারি। এর ফলে সে বেশি ক্যালরি পাবে। একই সাথে মাথায় রাখতে হবে তৈলাক্ত ও চিনিসমৃদ্ধ খাবারে যেন অভ্যস্ত না হয়ে যায়। পরবর্তী জীবনে স্থুলতার ঝুকি তৈরি হতে পারে।
এছাড়া, সঠিক পরামর্শের জন্য আপনার শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন। অথবা আমাদের প্রশ্ন করুন। প্রশ্ন করতে নিচের ফর্মটি ব্যাবহার করুন।
ডাঃ ফাহিম আহমাদ ২০০৬ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন। সরকারী বিধি অনুযায়ী দুই বছরের অধিক সময় গ্রামে কাজ করার পর শিশু রোগ সম্পর্কে উচ্চতর পড়াশুনা শুরু করেন। প্রায় ৪ বছর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু রোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এমডি(শিশু) শেষ করার পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে রেজিষ্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-এয় জুনিয়র কনসালটেন্ট (পেডিয়াট্রিক্স) হিসেবে কর্মরত আছেন।