কেমন আছে বাংলাদেশের শিশুরা?
বাংলাদেশের শিশু আইন অনুসারে যে কেউ ১৮ বছরের নিচে হলেই তাকে শিশু বলা হয়। কাজেই, শিশুরা আমাদের স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসাগুলোতে আছে। আছে বাসাবাড়িতে বা রাস্তাঘাটে। বিভিন্ন অবস্থায় থাকা শিশুরা বিভিন্ন ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়। শিশুর অবস্থা জানার সবচেয়ে সহজ উপায় হল মৃত্যুর কারণগুলো দেখা। ইউনিসেফের দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫ বছরের কমবয়সী বাচ্চার মৃত্যুর হার ৩০.৮ (প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মে)। এটা ২০ বছর আগের তুলনায় অনেক কম। তবে তারপরও অনেক বেশি বলতে হবে। যদিও বিডিএইচএস ২০১৭-২০১৮ মোতাবেক(BDHS 2017-2018), ২০১৭-২০১৮ সালে এই হার ছিল ৪৫ (প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মে)। সেই অবস্থা থেকে এই হ্রাস বিরাট অর্জন। সমস্যা হচ্ছে যতই সময় যাচ্ছে মৃত্যুহার কমছে কম হারে (নিচের ছবিতে লক্ষনীয়)।
কারণ, সহজে প্রতিরোধ করা যায় এমন মৃত্যুগুলো আমরা অনেকটাই প্রতিরোধ করে ফেলেছি। এখন যে সকল কারণে আমাদের শিশুরা মারা যাচ্ছে সেগুলো প্রতিরোধ ও প্রতিকার করার জন্য সবার সমন্বিত চেষ্টার সাথে সাথে হাসপাতাল, যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণের উপর বিনিয়োগ প্রয়োজন হচ্ছে।
বাংলাদেশের শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোঃ
নবজাতক মৃত্যু হার (neonatal mortality rate-NMR), ১ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু হার (Infant Mortality Rate-IMR), ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু হার (Under-5 mortality Rate- U5MR) কমার সাথে সাথে শিশুমৃত্যুর কারণগুলো পরিবর্তন হয়ে আসছে। আমাদের দেশের শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণগুলো দেখুনঃ
- নিউমোনিয়া
- অপরিণত অবস্থায় জন্ম সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতা
- নবজাতকের ইনফেকশন
- জন্মের সময় শ্বাস নিতে দেরি হওয়া সংক্রান্ত সমস্যা
- তীব্র ইনফেকশন (septicemia) ইত্যাদি
লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয় যে, ডায়রিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার এখন এত কম যে উপরের তালিকায় স্থান পায় নি। পুর্বের তুলনায় আমাদের শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমানো সম্ভব হয়েছে। তবুও তা অনেক বেশি। এবং এই মৃত্যুর বেশির ভাগ হচ্ছে জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে। শিশুমৃত্যুর একটা বড় অংশ নবজাতকের মৃত্যু।
নবজাতকের মৃত্যুঃ একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা
এই ২৮ দিনের মধ্যে আবার প্রথম ৭ দিন শিশুরা বা নবজাতকরা সবচেয়ে বেশি ঝুকির মধ্যে থাকে।
নবজাতকের মৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে আমরা খুব একটা সফল হতে পারছি না। কারণ, এটা শিশু মৃত্যু কমানোর মত সোজাসাপ্টা না।
জন্মের সময়ে শিশুর শ্বাসকষ্ট (birth asphyxia -বার্থ এসফিক্সিয়া), অপরিণত জন্ম (premature delivery), নবজাতকের সংক্রমণ (neonatal sepsis) ইত্যাদি নবজাতক মৃত্যুর মূল কারণ। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রসব পূর্ববর্তী, প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী সেবার উন্নয়ন করা জরুরি। সেজন্য সব ধরণের চিকিৎসার সেবা, সব জায়গায় উন্নত করার প্রয়োজন হয়। স্বাস্থ্য সেবার এই উন্নয়নে দীর্ঘ সময় এবং বড় আকারের বাজেট প্রয়োজন হয়।
নবজাতকের মৃত্যুর হার কমানো শুধুমাত্র নবজাতকের চিকিৎসা দিয়েই করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে, মা ও নবজাতককে একই সঙ্গে উন্নত স্বাস্থ্য সেবা দিতে হবে। সুস্থ্য মা-ই কেবল সুস্থ্য শিশুর জন্ম দিতে পারেন এবং সুস্থ্য রাখতে পারেন।
আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ
অন্য একটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত না করলেই না। আমাদের দেশের শিশু মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু। এ ব্যাপারেও আমাদের সচেতনতা কাম্য। বিস্তারিত পড়ুন এখানে।
সর্বশেষ যে বিষয়টির বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই সেটা হচ্ছে ‘শিশু নির্যাতন’। সামাজিক অবক্ষয় বাড়ার সাথে সাথে শিশু নির্যাতনও বাড়ছে। সেটা শারীরিক নির্যাতন হোক, আর যৌন নির্যাতন হোক। এগুলো শিশুর মনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। কাজেই, এ থেকে শিশুকে আগলে রাখা জরুরী।
কোভিড-১৯ এবং শিশুরা
বাংলাদেশের শিশুরা কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হলেও তাদের লক্ষণ প্রকাশ কম হয়ে থাকে। এবং তারা নিয়ম মানতে পারে না। ফলে, তাদের কারণে এই কোভিড-১৯ ছড়ায় বেশি। তবে, অল্প কিছু শিশুর ক্ষেত্রে রোগ তীব্রভাবে প্রকাশ পায়। একে multisystem inflammatory syndrome in children (MIS-C) বলা হয়। এটা খুবই আনকমন হলেও আমাদের দেশেও এটা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা শিশুরা বেশি বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ডেল্টার প্রকোপ কমে গেলেও এখন নতুন করে অমিক্রন নামক নতুন একটা ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে। এটাও শিশুদের বেশি আক্রান্ত করছে। কাজেই, প্রত্যেককেই সচেতন থাকতে হবে যেন শিশুরা এই ভয়ানক রোগ থেকে বেচে থাকতে পারে।
আমেরিকান সিডিসি (US CDC) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে শিশুদেরও নিয়ম মানতে হবে। যেমন- পারষ্পরিক দুরত্ব বজায় রাখা। ঘর থেকে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া এবং ঘন ঘন হাত ধোয়া মেনে চলতে হবে। তবে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মাস্ক পড়া জরুরী না।
ডাঃ ফাহিম আহমাদ ২০০৬ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন। সরকারী বিধি অনুযায়ী দুই বছরের অধিক সময় গ্রামে কাজ করার পর শিশু রোগ সম্পর্কে উচ্চতর পড়াশুনা শুরু করেন। প্রায় ৪ বছর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু রোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এমডি(শিশু) শেষ করার পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে রেজিষ্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-এয় জুনিয়র কনসালটেন্ট (পেডিয়াট্রিক্স) হিসেবে কর্মরত আছেন।