বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ এটা কে না জানে? কিন্তু নদী ছাড়াও অসংখ্য খাল-বিল, পুকুর আর ডোবায় ভর্তি সারাদেশ। সারাদিনই বিভিন্নভাবে এগুলো দ্বারা উপকৃত হলেও বিপদের কারণও কম হয় না। পানিতে ডুবে মৃত্যুএর মত দুর্ঘটনা ঘটে প্রতিবছর অনেক মানুষের। এর মধ্যে আবার নারী এবং শিশুরা বেশি ঝুকির মধ্যে থাকে।
সামগ্রিকভাবে দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যু এড়ানোর জন্য উদ্যোগ কমবেশি যাই থাকুক না কেন, শিশুমৃত্যু সবসময়ই আলাদা মনযোগ দাবী করে।১-৪ বছর বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি।
The Bangladesh Health and Injury Survey (BHIS 2003–2004) এর মাধ্যমে প্রকাশ পায় যে ১-১৭ বছরের শিশু-কিশোরদের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রতি লাখে প্রতি বছরে ২৮.৬ এবং ১-৪ বছরের শিশুদের মধ্যে ৮৬.৩। একই গবেষণায় দেখা যায় যে ১-৪ বছরের শিশুদের মৃত্যুর হার ২০০৫ এর ২৬% (মোট পানিতে ডুবে মৃত্যুর) থেকে বেড়ে ২০১১ সালে ৪২% হয়েছে।
পানিতে ডুবে মারা যাওয়া ঠেকাতে দুই ধরণের পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরী। ১নং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া এবং ২নং প্রাথমিক চিকিৎসা। কারণ, যারা পানিতে ডুবে মারা যায় তারা সাধারণত হাসপাতালে পৌছার পূর্বেই মারা যায়।
কি প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া যায়?
সাধারণ ব্যবস্থাঃ
১। সিপিআর শেখাঃ কার্ডিওপালমোনারী রিসাসিটেশন। এর মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া ফুসফুস ও হৃদপিণ্ড পুনরায় সচল করা। সঠিক সময়ে করলে এটা জীবন বাঁচানোর উপায় হতে পারে। শুধু পানিতে ডুবা না, হার্ট এটাকের রোগীকেও এর মাধ্যমে বাঁচানো যায়। আমরা সাধারণ জনগণকে যত বেশী প্রশিক্ষণ দিব তত বেশি সম্ভাবনা যে দুর্ঘটনার সময় একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক আশেপাশে থাকবে। এজন্য বেশি বেশি প্রশিক্ষণএর ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা।
২। সার্বক্ষণিক মনযোগ দেয়া। শিশুদের চোখের সামনে রাখতে হবে। বিশেষ করে ১-৪ বছরের শিশুর উপর।
৩। সাঁতার শেখানো। অল্প বয়স থেকেই শিশুদের শেখানো উচিত। বিশেষ করে যে সকল শিশু পানির আশে পাশে থাকে। আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স এর মতে যেকোন ৪ বছরের শিশু সাঁতার শিখতে পারে। শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে আরো কম বয়সী বাচ্চারাও শিখতে পারে।
পুকুর বাঁ সুইমিং পুলের ক্ষেত্রেঃ
১। কম বয়সী বাচ্চার পানির কাছে যাওয়ার সুযোগ সীমিত করতে হবে। এটা বেড়ার মাধ্যমে করা যেতে পারে। বর্ষাকালে ড্রেইনের বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
২। পানিতে বাঁ পানির কাছে কোন খেলনা না রাখা। খেলনা নিতে গিয়েও শিশু পানিতে পড়ে যেতে পারে।
৩। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা প্রয়োজনীয় হতে পারে তা হাতের কাছে রাখা। যেমন- বয়া ইত্যাদি।
বাথরুমের ক্ষেত্রেঃ
১। দরজা বন্ধ রাখতে হবে। সব সময়।
২। বাচ্চাদের কখনোই গোসলখানায় একা রাখা যাবে না।
৩। টয়লেটের ডালা সব সময় বন্ধ রাখা।
৪। বড় বালতি/বোল বাঁ বাথটাবে পানি রেখে না দেয়া। অনেক ছোট শিশুই দুর্ঘটনাক্রমে এমন পানিতে পড়ে মারা যায়।
পানিতে ডুবার প্রাথমিক চিকিৎসা কি?
সংক্ষিপ্ত আকারে বলছিঃ
১। কখনো যদি শিশুকে পাওয়া না যায় প্রথমেই পানিতে খুজুন। প্রতিটা সেকেন্ডই অত্যন্ত মূল্যবান।
২। পানিতে পাওয়া শিশুকে সবার আগে পানি থেকে সরিয়ে নিয়ে আসুন।
৩। বুক এবং পেট থেকে পানি বের করার চেষ্টা করুন। একদম ছোট বাচ্চা হলে বাঁ হাতের উপর বাচ্চাকে উপুর করে নিন এবং পিঠে হালকা চাপড় দিন। একটু বড় হলে হাটু অর্ধেক ভাজ করে উরুর উপরে উপুর করে শুইয়ে দিন। বা উপুর করে কাধে নিন। ফলে, বুক এবং পেট থেকে পানি বের হয়ে যাবে।
৪। চিত করে শুইয়ে দিন। এবং সিপিআর শুরু করুন। বুকে চাপ দিন এবং মুখে শ্বাস দিন।প্রতি ৩০টি চাপ দেয়ার পর দ্রুত দুইবার মুখে শ্বাস দিবেন।
কিভাবে বুকে চাপ দিবেন?
বড়দের জন্যঃ এর জন্য মাটিতে চিত করে শুইয়ে দিন। দুই হাতের আঙ্গুলগুলো একটা আরেকটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিন। এরপর বুকের মাঝ বরাবর চাপ দিন।
১ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রেঃ বাচ্চাকে বাঁ হাতের উপর চিত করে নিন এবং ডান হাতের মধ্যমা এবং তর্জনী একত্র করে চাপ দিন।
একটু বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রেঃ এমনভাবে দুই হাতে বুককে ধরুন যেন দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি বুকের মাঝ বরাবর থাকে। এরপর চাপ দিন।
শ্বাস কিভাবে দিবেন? ছবিতে দেখুন। তবে কিভাবে দিতে হবে তা না জানা থাকলে শুধু বুকে চাপ দিলেও চলবে।
৫। যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিন। স্বাভাবিক শ্বাস চালু হলে সিপিআর বন্ধ করে দিন। নতুবা হাসপাতালে পৌছা পর্যন্ত চালিয়ে যান।
তবে, খেয়াল রাখবেন ‘বাচ্চাকে মাথায় বা কাধে উঠে ঘুরানোর’ মত কাজ কখনই করবেন না। এতে বাচ্চার মারাত্বক শারীরিক ক্ষতি হতে পারে।
প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একটি প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার বিষয়ে ট্রেইনিং আছে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেনঃ
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
ডাঃ ফাহিম আহমাদ ২০০৬ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন। সরকারী বিধি অনুযায়ী দুই বছরের অধিক সময় গ্রামে কাজ করার পর শিশু রোগ সম্পর্কে উচ্চতর পড়াশুনা শুরু করেন। প্রায় ৪ বছর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু রোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এমডি(শিশু) শেষ করার পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে রেজিষ্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-এয় জুনিয়র কনসালটেন্ট (পেডিয়াট্রিক্স) হিসেবে কর্মরত আছেন।
1 thought on “সতর্কবার্তা: বর্ষাকালে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ পানিতে ডুবা”